আকাঙ্ক্ষা বিপুল, সামর্থ্য কম

বিশেষ প্রতিনিধি | আপডেট: ১৫:৩৫, জুন ০৩, ২০১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার ৬৪ পাতায় ১৭২ অনুচ্ছেদটি পড়ুন। অর্থমন্ত্রী সেখানে বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এটি আসলেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা। বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ হার হবে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হলেও তা অর্জন করার মতো জনবল ও সক্ষমতা এনবিআরের আছে। বিগত কয়েক বছরে তাদের জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এবার চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার ৬৫ পাতায় ১৯১ অধ্যায়টি আমরা পড়তে পারি। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এনবিআরকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই আদায়ের হার হবে ৩০ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি, যা সত্যিই উচ্চাভিলাষী। তবে গত ছয় বছরে তাদের জনবল ও দপ্তর বেড়েছে ব্যাপকভাবে। এবার তাদের চ্যালেঞ্জ হলো, উচ্চাভিলাষী এই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক দফা কমিয়েও অর্জন করা যাচ্ছে না। আদায়ের প্রবৃদ্ধি এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ শতাংশ। তারপরও অর্থমন্ত্রী ভরসা রেখেছিলেন নতুন মূল্য সংযোজন করের (মূসক বা ভ্যাট) ওপর। কিন্তু তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি ছিল না সরকারের। ফলে শেষ সময়ে এসে নতুন আইন বাস্তবায়ন এক বছর স্থগিত রাখতে হলো। তারপরও নতুন অর্থবছরের জন্য ৩৫ শতাংশেরও বেশি রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়াবে বলেই মনে হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেটটি দিলেন, তার নাম দিয়েছেন ‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা’। আর বক্তৃতাটি শুরু করেছেন জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৭ শতাংশের মাইলফলক স্পর্শ করার সুসংবাদ দিয়ে। অর্থমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা, নতুন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ জন্য অর্থমন্ত্রী বাজেটে কতগুলো ইচ্ছাতালিকার কথা বলেছেন। যেমন তিনি মনে করছেন, নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে প্রবাসী আয়, বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথগতিতেও রপ্তানি আয়ে আরও প্রবৃদ্ধি হবে, বাড়বে মানুষের ভোগ-ব্যয়, থাকবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কমবে মূল্যস্ফীতি এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায়। কিন্তু এগুলো কীভাবে হবে, তার কোনো নতুন পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে নেই। নেই সংস্কারের নতুন কোনো পরিকল্পনা। ফলে নতুন বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। যেমনটি ছিল গত বছর। সন্দেহ যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ তো হয়েই গেছে। বাস্তবায়িত হয়নি চলতি অর্থবছরের বাজেট।
সামগ্রিকভাবে আশাবাদী অর্থমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা অনেক, কিন্তু সক্ষমতার ঘাটতিও প্রকট। ফলে রাজস্ব আদায় হয় কম, উন্নয়ন বাজেট পুরোটা ব্যয় করা যায় না, ঠিক থাকে না অনুন্নয়ন বাজেটও। তারপরও নতুন অর্থবছরে আবার বড় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উপস্থিত হলেন এখন পর্যন্ত ১০ বার বাজেট দেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত।
অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটটি ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে উন্নয়নমূলক ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা। আর ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। ফলে অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি অর্থমন্ত্রী মেটাবেন ঋণ করে। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা এবং বাকি ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে। বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে থাকলেও অর্থমন্ত্রীর দুশ্চিন্তা এখানেও। কারণ, অর্থমন্ত্রী বাজেটে নিজেই বলেছেন, ‘অর্থায়নের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের দিকে আমরা কিছুটা ঝুঁকে পড়েছি। এরূপ চলতে থাকলে সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই অভ্যন্তরীণ ব্যয়বহুল অর্থায়নের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তার ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।’ কিন্তু কীভাবে করবেন, তা আর অর্থমন্ত্রী বলেননি।
বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বছর ধরেই একই জায়গায় স্থির। বিনিয়োগ না বাড়ার কারণগুলোও অর্থমন্ত্রী জানেন। তার বিস্তারিত বর্ণনাও তিনি বক্তৃতায় দিয়েছেন। এ জন্য বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা বলেছেন। পাশাপাশি অনেকগুলো স্থানীয় শিল্পকে দিয়েছেন নানা ধরনের সুরক্ষা। তবে ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করেও। বাড়িয়েছেন প্যাকেজ ভ্যাটের হার। এতে নতুন ভ্যাট বাস্তবায়ন করতে না দেওয়ার স্বস্তি আর পাননি আন্দোলনরত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী কয়েকটি শিল্পের উৎসে করের হার বাড়িয়েছেন, যা তাদের খুশি করেনি। আমদানি শুল্কের স্তরের পরিবর্তন এনেছেন। খুব বেশি পরিবর্তন আনেননি আয়করের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ব্যক্তিশ্রেণির করের সীমা আগের মতোই আছে। দাবি থাকলেও তৈরি পোশাক ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানের আয়কর কমানো হয়নি। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, নতুন অর্থবছরে তাঁদের ওপর করের চাপ অনেক বেশি বাড়বে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর কারণে চাপ পড়তে পারে সাধারণ ভোক্তাদের ওপরও। নতুন বাজেট চাপ বাড়াবে, না স্বস্তি দেবে—সেটাই এখন প্রশ্ন।

 

Source Link: https://goo.gl/cUOn8S

Source: The Daily Prothom Alo

Updated Date: 9th March, 2017

Related Publications

Yunus Social Business Week launched in China...

Published Date: 15th October, 2015

Grameen China to set up branch in Shenzhen ...

Published Date: 16th October, 2015